কাজী মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী রহ ছিলেন ভারতবর্ষের মুসলিম মিল্লাতের অতন্দ্র প্রহরী
ভারতবর্ষে তিনি ছিলেন মুসলিম মিল্লাতের অতন্দ্র প্রহরী
মুহাম্মদ নাযিম রাহমানী
৫ এপ্রিল ২০০২ ঈসায়ী রাতে সংবাদ পেলাম হযরত কাজী মুজাহিদুল ইসলাম কাসেমী রহ আর দুনিয়াতে নেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।' 'তাঁকে আল্লাহ জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।
কাজী সাহেবের ব্যক্তিত্ব ছিল আমাদের জন্য একজন পৃষ্ঠপোষকের মতো, যেকোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে কাষী সাহেবের পরামর্শ ছিল আমাদের জন্য অনিবার্য। এ কারণে কতবার যে আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয় পিছিয়েছি তবুও তাঁর পরামর্শের অপেক্ষা করেছি। কাযী সাহেবকে কাছ থেকে বরং একান্ত ঘনিষ্ঠভাবে কয়েকবার দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। মুহতারাম ভাই মাওলানা কাসেম-এর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের সুবাদে আমার মধুপুরের বাসায় তিনি একাধিকবার এসেছেন। এ কারণে তিনি আমাদেরকে বেশ স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন।
তাঁর ইলমী মজলিসগুলোতেও বেশ কয়েকবার বসার সুযোগ আমার হয়েছে। আল্লাহ তাঁর মাঝে ইসলামী বিধিবিধান সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করার যে যোগ্যতা দান করেছেন, তা সমকালীন ওলামায়ে কেরামের মাঝে বিরল, বরং পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরামের মাঝেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য খুব কমই দেখা যায়। তিনি ছিলেন আল্লাহপ্রদত্ত এক বিস্ময়কর যোগ্যতার অধিকারী যা দেশ বিদেশের ওলামা ও ইসলামী স্কলারগণ নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেন। কোন ইলমী মজলিসে তিনি অনুপস্থিত থাকলে মনে হতো, মজলিসটি নিষ্প্রভ, অনুরূপভাবে আত্মশুদ্ধিমূলক বৈঠকগুলোতে তিনি না থাকলে মনে হতো, বৈঠকটি অসম্পূর্ণ। কেননা, আল্লাহ তাআলা তাঁকে বক্তব্য উপস্থাপনার এক অনুপম কৌশল দান করেছিলেন, যা ছিল অন্যান্যদের মাঝে বিরল। তিনি শ্রোতার পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রাখতেন বেশি। বড় বড় আলেম থেকে শুরু করে সাধারণ অশিক্ষিত পর্যন্ত তাঁর বক্তৃতায় বিমুগ্ধ হতো।
তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, তিনি উঁচুমানের লোক হওয়া সত্ত্বেও ছোটদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার গরীবদের প্রতি তিনি বিশেষভাবে নজর দিতেন। সাধারণ মানুষের দুঃখ, কষ্ট, বেদনা তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। যখনই এলাকায় আসতেন, এলাকার বড়-ছোট সকলের সঙ্গে আবেগ ও মহব্বতের সঙ্গে দেখা করতেন।
উম্মতের প্রতি ছিল তাঁর এক বুক দরদ। তাদের ব্যথায় তিনি ক্লিষ্ট হতেন। কোথাও মুসলমানরা নির্যাতিত হয়েছে শুনলে কিংবা তাদের সঙ্গে বিমাতাসূলভ আচরণ ও দ্বৈতনীতি গ্রহণ করা হয়েছে- এ সংবাদ তাঁর কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শিরা-উপশিরায় রক্ত টগবগিয়ে ওঠতো এবং সমাধানের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়তেন। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এমন অনেক লড়াই-বিবাদ তিনি অনায়াসে মিটমাট করে দিয়েছেন। এ কেবল তাঁর দ্বারাই সম্ভব ছিল। ভারতবর্ষের মুসলমানদের অনগ্রসরতা, দুর্বলতা ও শিক্ষার প্রতি হেয়-মনোভাব দেখে তিনি খুব বিচলিত হতেন এবং তাদের উন্নতির জন্য উপকরণসমূহ সহজলভ্য করার চেষ্টা তিনি সব সময়ই করতেন।
আল্লাহ তাআলা হযরত কাযী সাহেবকে সৎ সাহস নামক গুণ পরিপূর্ণভাবে দান করেছিলেন। এ গুণ-বৈশিষ্ট্য তাঁর পূর্ণমাত্রায় থাকার কারণে কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয়সমূহের সমাধান সহজভাবে করতে পেরেছেন। ভারতে মুসলমানরা হলো সংখ্যালঘু। তাদের জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়গুলো এ
দেশে একেবারে অপ্রতুল। হযরত কাযী সাহেব এ পরিস্থিতিতে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ইসলামিক ফিকাহ একাডেমী, মিল্লি কাউন্সিল, আল মা'হাদুত তাদরীব লিল-কাযা ওয়াল ইফতা' নামক তিন তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যে দেশে মুসলমানদের জন্য সবকিছু অত্যন্ত সহজলভ্য, সে দেশে যদি খালেস কোন ইলমী কাজ শুরু করা হয়, তাহলে এটা খুব একটা আশ্চর্যজনক নয়। কিন্তু যে দেশে মুসলমানদের হাতে কোন উপকরণই নেই এবং সরকার থেকে কোন সাহায্য যারা পায় না, সে দেশে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান এত নিপুণতার সঙ্গে গড়ে তোলা উন্নত সাহসিকতার পরিচয় বৈ কি! অবশ্যই তিনি বড়দের পরামর্শক্রমে উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করেছেন, তবে এগুলোর মূল উদ্যোক্তা তো তার দিল ও দেমাগ থেকে এসেছিল । প্রায় দেড়শ বছরব্যাপী এসব মাদরাসা ও ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমেই ভারতবর্ষে ইসলাম সংরক্ষিত হয়ে আসছে। এজন্যই দেখা যায়, গোঁড়া হিন্দুবাদীদের দল বজরং দল ও বি. এইচ, পির সবচেয়ে বড় জ্বালা হচ্ছে এ মাদরাসাগুলো। এজন্য জঙ্গিসুলভ আচরণ উক্ত দু'দল একাধিকবার করেছে। এদের দুরভিসন্ধি হলো, ভারতবর্ষের মাদরাসাগুলোকে অপপ্রচারের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে বাধ্য করা। যেন ইসলামী শিক্ষা ও মুসলমানদের অবস্থান ঐতিহ্যরহিত হয়ে পুরনো ইতিহাসের পাতায় আশ্রয় নেয়। এজন্য হযরত কাযী সাহেবের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও দাওয়াত ছিল, যেখানে পার ও যত পার দীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা কর। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর তৎপরতা ছিল আরো বেশি। এ কারণেই আমরা যখন সাইয়েদ মিন্নাতুল্লাহ রাহমানী, চতুর্থ আমীরে শরীয়তের নির্দেশে নিজ গ্রাম মধুপুরে মাদরাসা তাইয়েবার ভিত্তিপ্রস্তর রাখি এবং হযরত কাষী সাহেব যখন এ সংবাদ পান, তখন তিনি খুব খুশি প্রকাশ করে দুআ করেন এবং মাদরাসার পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করে পরামর্শদানে আমাদের ধন্য করেন।
বর্তমানে ইসলামের ধারক-বাহক ওলামায়ে কেরাম ও বুদ্ধিজীবীগণ চিন্তা চেতনার দিক থেকে দু'ভাগে বিভক্ত। একটি দল পূর্বসূরী আকাবির ও আসলাফের কর্ম ও অবদান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বরং তাঁদের উন্নত গবেষণা ও ইজতেহাদের ওপর অনর্থক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে এবং সকল মাসআলা নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে সমাধান করে নিজেদের যোগ্যতার অহেতুক কসরত প্রদর্শনীতে লিপ্ত হচ্ছে, অপরদিকে অন্য দল যারা আকাবির আসলাফের আঁচলে থাকাকেই নিজেদের মুক্তির পথ হিসাবে ধরে নিয়েছে। যার কারণে তারা নিত্যনতুন সৃষ্ট বিভিন্ন মাসআলার ব্যাপারে আকাবিরের মতামতকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। যদিও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এ ব্যাপারে আকাবিরের আমলের মাঝেও ভিন্নতা রয়েছে এবং যদি তারা আকাবিরের কিতাবগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করে, তাহলে সহজেই অনুভব করবে যে, তাদের এ অবস্থান সঠিক নয়।
বলা বাহুল্য, উক্ত উভয় দলই ভারসাম্যমূলক অবস্থান থেকে যথেষ্ট দূরে অবস্থান করছে, প্রকারান্তরে ইসলামের সঠিক অবস্থান থেকেই চলে গিয়েছে। প্রথম দলকে যদি বাড়াবাড়িতে লিপ্ত বলা হয়, তবে দ্বিতীয় দল সম্পর্কে বলা যেতে পারে, তারা ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত। অথচ ইসলামের সঠিক অবস্থান হলো, এ দুয়ের মাঝামাঝি স্থানে। ইসলামের এ মধ্যপন্থায় চলতে হলে প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল ও উন্নত মেধা। পূর্বসূরী ওলামায়ে কেরাম ইসলামের এ মধ্যপন্থাটিই অবলম্বন করেছেন। তাঁদের গোটা জীবনের কর্মকৌশল ছিল, আকাবির-আসলাফের মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই যুগের চাহিদারও মূল্যায়ন করা। একান্ত প্রয়োজনে তাঁদের মতামতকে সম্মানের সঙ্গে করেছেন। হযরত কাযী সাহেব ছিলেন, এ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারীদের মধ্য থেকে। বরং গোটা জীবন এ পথে তিনি একজন নকীবের ভূমিকায় ছিলেন। উম্মতকে তিনি সর্বদা বিষয়টি বুঝিয়েছেন, ফলে 'আলহামদুলিল্লাহ. ওলামায়ে কেরামের এক বড় দল দেরিতে হলেও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আজ উম্মতের জন্য প্রয়োজন এমন একদল আলেম যারা মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে এবং মুসলমানদের সমস্যাগুলো দিল ও দেমাগ দ্বারা অনুধাবন করবে।
কোন মন্তব্য নেই
Please do not enter any spam link in the comment box.