Header Ads

Header ADS

আদর্শ সেনানায়ক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ড. এ. কে. এম. আইয়ুব আলী

 


আদর্শ সেনানায়ক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম

ড. এ. কে. এম. আইয়ুব আলী

সৃষ্টির বিবর্তন ধারায় মানব জাতি সৃষ্টির সেরা আশরাফুল মাখলুকাত, ধর্মের বিবর্তন ধারায় ইসলাম বিশ্বমানবের সার্বজনীন আদর্শ জীবন ব্যবস্থা এবং নবুওয়াত ও রিসালাতের ধারাবাহিকতায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন নবুওয়াতের মোহর সর্বশেষ নবী, খাতামুন নাবীয়ীন এবং রাসূলদের শিরোমণি সাইয়্যিদুল মুরসালীন। যে অনন্য বৈশিষ্ট্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নবীকুল শ্রেষ্ঠ মর্যাদা দিয়েছে তা হলো একাধারে নবুওয়াত ও খিলাফত, রিসালাত ও নিয়ামাতের মহান দায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত হয়েছিল। পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণ বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ গোত্রের মধ্যে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হয়েছেন ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের সমন্বয় সাধন করে সর্বকালের সর্বদেশের সর্বজাতির মানবকুলের সামগ্রিক জীবনের সার্বিক কল্যাণের সঠিক পথ ও পদ্ধতি নির্দেশনার জন্য । বিক্ষুব্ধ বিশ্বের উদ্ভাস্ত মানুষের জন্য তিনি নিয়ে এসেছিলেন বিশ্বজনীন শান্তি, প্রেম ও সৌভ্রাতৃত্বের মহাপয়গাম। তাঁর এই মহান দায়িত্ব সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলার ঘোষণা— وما أرسلنك الا رحمة للعلمين

“আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমত ও করুণা রূপেই প্রেরণ করেছি।” (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন- وما أرسلنك الأكافة للناس بشيرا ونذيراً

“আমি তো আপনাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।” (সূরা সাবা : ২৮)

পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলদের দায়িত্ব ছিল স্বগোত্রীয় ও স্বজাতীয় লোকদের মধ্যে ধর্মের প্রচার, রাষ্ট্রীয় প্রভাব দ্বারা জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্মের প্রতিষ্ঠা তাদের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

তারা সকলেই বলতেন- وما علينا الأ البلغ

“আমাদের দায়িত্ব তো শুধু প্রচার করা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মক্কী জিন্দেগীতেও প্রথমে নিকটাত্মীয়দের মধ্যে, পরে প্রকাশ্যে জনগণের মধ্যে আল্লাহর বাণী প্রচারের নির্দেশ আসে।

আল কুরআনের ভাষায়- يأيها المدثر، قم فانذر، وربك فكبر.

“হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! উঠুন, সতর্কবাণী প্রচার করুন এবং আপনার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।” (সূরা মুদ্দাচ্ছির : ১-৩)

فلا تدع مع الله الها أخر فتكون من المعذبين وانذر عشيرتك الاقربين

“অতএব, আপনি অন্য কোন ইলাহকে আল্লাহর সাথে ডাকবেন না, ডাকলে আপনি শাস্তিপ্রাপ্তদের শামিল হবেন এবং আপনার নিকট আত্মীয়বর্গকে সতর্ক করে দিন।” (সূরা শু’আরা২১৩-১৪)

فاصدع بما تؤمر وأعرض عن المشركين

“অতএব আপনি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছেন তা প্রকাশ্যে প্রচার করুন এবং অংশীবাদীদের উপেক্ষা করুন।” (সূরা হিজর ৪৯৪)

আল্লাহর নির্দেশ মতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কাবাসীদের মধ্যে আল কুরআনের আয়াতসমূহ প্রচার এবং জনগণকে পৌত্তলিকতা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বানের উদ্যোগ নিলে কুরাইশ দলপতিগণ বিভিন্ন পন্থায় তাতে বাধা দিতে সচেষ্ট হয়।

আল্লাহর কালাম শুনে যাতে কেউ ইসলামে দীক্ষিত হবার সুযোগ না পায় সেজন্য পৌত্তলিকগণ যে সব বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি করত সে সম্বন্ধে কুরআনুল করীমে বলা হয়েছে-

وقال الذين كفروا لا تسمعوا لهذا القرآن والغوا فيه لعلكم تغلبون

“কাফিররা বলত! তোমরা এ কুরআন শোনো না এবং এর আবৃত্তিকালে তোমরা শোরগোল করবে, যাতে তোমরা জয়ী থাকতে পার।” (সূরা হা-মিম আস সিজদা : ২৬)

পৌত্তলিক মক্কাবাসীদের নানা অপকৌশল সত্ত্বেও আল্লাহর কালামের হৃদয়গ্রাহী মাধুর্য ও ইসলামী জীবন পদ্ধতির মহান আদর্শে মুগ্ধ হয়ে কিছুসংখ্যক লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিলে আধিপত্য ও প্রতিপত্তি বিলোপের আশংকায় কুরাইশগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নও-মুসলিমদের উপর অমানুষিক অত্যাচার শুরু করে। প্রস্তরাঘাতে নবীজীর পবিত্র দেহ ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে, নামাযে সিজদারত অবস্থায় তার মাথার উপর উটের নাড়ীভুঁড়ি চাপা দিয়ে তাকে যাতনা দেওয়া হয়েছে, নামাযে যাতায়াতের পথে বিষাক্ত কাঁটা ফেলে রাখা হত, তাঁর প্রাণ নাশেরও বহু চেষ্টা নেয়া হয়। মানববন্ধু, রহমতে আলম এসব অত্যাচার ও নিপীড়ন নীরবে সহ্য করেন এবং এদের হিদায়াত ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করতেন।

বহু প্রলোভন, ভীতি ও নির্যাতনেও আল্লাহর নবী ইসলামের শান্তির বাণী প্রচারে বিরত না হলে কুরাইশগণ তাঁকে ও তাঁর সাহাবীগণকে শিআবে আবি তালেব নামক সংকীর্ণ গিরি উপত্যকায় বন্দীজীবন যাপনে বাধ্য করে, খাদ্যদ্রব্যাদির সরবরাহ পথ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে অনাহারে তাদের প্রাণ নাশের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করে। কতিপয় অসহায় মুসলমান অনন্যোপায় হয়ে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা করলে তাঁর অনুরক্ত ভক্ত ও স্বীয় হাশেমী গোত্রের মধ্যে গোত্রীয় চেতনা উজ্জীবিত করে গুপ্ত হত্যা বা সন্ত্রাসবাদের ন্যায় অমানবিক পন্থায় এসব নৃশংস নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে পারতেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দয়াল নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা তাঁর কোন সহচর ইসলাম ও মুসলিমদের এরূপ সংকটময় মুহূর্তেও শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী কোন হিংসাত্মক পন্থা কিংবা নাশকতামূলক গোপনীয় কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করেননি। মানব প্রেম, ন্যায়বিচার, জনকল্যাণ ও বিশ্বশান্তির মহা পরিকল্পনা নিয়ে মহানবীর আবির্ভাব, তাতে হিংসাত্মক, ধ্বংসাত্মক কিংবা সন্ত্রাসমূলক কোন কর্মকাণ্ডের স্থান নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠা শুধু ন্যায়সম্মত পন্থা ও সত্যনিষ্ঠ পদ্ধতি অবলম্বনের মাধ্যমেই সম্ভব ।

মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যে কোন পথ ও পন্থা অবলম্বন সঙ্গত, ইসলাম এরূপ মতাদর্শ কখনও সমর্থন করে না। কাজেই রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজীবন ইসলাম প্রচারে ন্যায় নীতির অনুসরণ এবং শান্তির পথ অবলম্বন করেছেন। মক্কী জীবনের দুর্বল ও অসহায় অবস্থায়ই শুধু নযে‌; বরং আজীবন তিনি মানবিক নীতি ও অহিংসপদ্ধতি আন্তরিকভাবে অনুসরণ করেছেন। ইসলাম প্রচারের যে নীতি ও পদ্ধতি আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছিল সমগ্র আরব ভূমিতে ইসলামের আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পরও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই মহান নীতি আদর্শ ও পদ্ধতি হতে কখনও বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।

এ সম্বন্ধে আল্লাহর নির্দেশ ছিল-

أدع إلى سبيل ربك بالحكمة والموعظة الحسنة وجادلهم بالتي هي أحسن

“আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ দ্বারা এবং বিরোধীদের সাথে আলোচনা করুন সর্বোত্তমভাবে।” (সূরা নাহল :১২৫)

মানবাধিকারের মৌলিক নীতি অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ পন্থায় স্বাধীনভাবে আল্লাহর দীনের প্রচার ও ইবাদত বন্দেগীর অধিকার। আল্লাহর নির্দেশ মতে তিনি ঘোষণা করেছিলেন-

لكم دينكم ولی دین ۔

“তোমাদের দীন তোমাদের, আমার দীন আমার।” (সূরা কাফিরুন ঃ৬)

প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইচ্ছা করলে তখন লুণ্ঠনপ্রিয় দুর্ধর্ষ মরু বেদুইনদের নিয়ে একটি গুপ্ত ঘাতক বাহিনী গঠন করতে পারতেন। তিনি জানতেন যে, এ জাতীয় বাহিনী দ্বারা সাময়িকভাবে ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা যায়, কিন্তু মহান আদর্শ ও মতবাদ এদের সাহায্য-সহায়তায় সু-প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এজন্যই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংঘাত-সংঘর্ষ ও রক্তপাত এড়ানোর উদ্দেশ্যে মদীনায় হিজরতের সংকল্প করেন। তৎকালীন ‘ইয়াছরিব’ কে তাঁর প্রধান কর্মক্ষেত্র এবং ভবিষ্যতে ইসলামী খিলাফতের কেন্দ্ররূপে নির্বাচন করার লক্ষ্যে তাঁর গভীর প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার প্রমাণ সুস্পষ্ট। মক্কা শরীফ তাঁর প্রিয় জন্মভূমি। বিশ্ব মুসলিমের প্রাণকেন্দ্র বায়তুল্লাহ এখানে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পবিত্র ভূমিকে প্রতিশ্রুত দেশ ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী রূপে যেসব কারণে মনোনীত করেননি তার মধ্যে অন্যতম হলো, কাবাগৃহ যেন শত্রুপক্ষের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত না হয় এবং কোনরূপে এর পবিত্রতা ও বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট না হয়।

রিসালাত ও খিলাফতের যে গুরুদায়িত্ব মহানবীর উপর ন্যস্ত হয়েছিল তা সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য যে বাস্তব অভিজ্ঞতা, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে বিচক্ষণতা ও কর্মনিপুণতা এবং সুযোগ্য সহকর্মীবৃন্দের প্রয়োজন এসব প্রস্তুতিপর্ব শেষ হবার পরই যথাসময়ে আল্লাহর নিকট হতে হযরতের নির্দেশ আসে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নির্দেশেরই প্রতীক্ষায় ছিলেন। বস্তুত মি’রাজের রজনীতে ইসলামের উজ্জ্বল ভবিষ্যত এবং প্রতিশ্রুত ইসলামী রাষ্ট্রের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি তাঁকে প্রদর্শন করা হয়েছিল। হিজরতের প্রাক্কালে একদিকে প্রিয় জন্মভূমি ও বায়তুল্লাহ শরীফ হতে বিদায় নিতে মহানবীর হৃদয় দুঃখ-ভারাক্রান্ত, অন্যদিকে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর খিলাফত কায়েমের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আশার আলোকে তাঁর হৃদয়মন উদ্ভাসিত। হিজরতের শুভক্ষণে আল্লাহ্ তা’আলা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দোআ পাঠের নির্দেশ দিয়েছিলেন তা থেকেও তিনি দৃঢ়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন নানাবিধ প্রতিকূলতা ও বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও য়াছরিবে একটি শান্তির রাজ্য অনতিবিলম্বে প্রতিষ্ঠিত হবে।

আল্লাহর নির্দেশিত দোআ

وقل رب أدخلني مدخل صدق وأخرجني مخرج صدق واجعل لي من لدنك سلطنا نصيرا ـ وقل جاء الحق وزهق الباطل ان الباطل كان زهوقا .

“বলুন, হে আমার রব! আমাকে (মদীনায়) প্রবেশ করাও কল্যাণের সাথে এবং আমাকে রওয়ানা করাও (মক্কা হতে) কল্যাণের সাথে এবং আমাকে দান করো তোমার নিকট হতে সাহায্যপুষ্ট শক্তি। আরও বলুন সত্য সমাগত এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। মিথ্যা অবশ্যই বিলুপ্ত হয়ে থাকে।” (সূরা বনী ইসরাঈল ৮০-৮১)

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর য়াছরিব শহরে আগমন ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী চিরস্মরণীয় ঘটনা। এই হিজরত সুদৃঢ় শাস্তকণ্ঠে ঘোষণা করেছিল অত্যাচার-অবিচার, নির্যাতন ও শোষণের বিভীষিকাময় অন্ধকার যুগের অবসানের এবং ন্যায়বিচার, সাম্য-মৈত্রী-ভ্রাতৃত্বের এক উজ্জ্বল যুগের শুভ সূচনার। ন্যায়, সত্য, কল্যাণ ও শাস্তির পয়গাম নিয়ে মহানবী এসেছিলেন য়াছরিব। আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠাই যে নবী পাকের হিজরতের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল, ব্যক্তিগত বা দলীয় বৈষয়িক কিংবা জাগতিক কোন স্বার্থচিন্তা যে এর সাথে আদৌ জড়িত ছিল না, আল কুরআন, আল হাদীস এবং সমসাময়িক ইতিহাসের সাক্ষ্য হতে তা সুপ্রমাণিত।

আল্লাহর বিধানসমূহ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং বৃহত্তর মানবগোষ্ঠির মধ্যে শাস্তিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে খিলাফাতুল্লাহ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও প্রাথমিক কর্মপদ্ধতি তিনি য়াছরিবে আগমনের অব্যবাহিত পরেই গ্রহণ করেন, য়াছরিবের অধিবাসীরা শান্তির দূত এবং মানবের বন্ধুরূপেই মহানবীর সাদর সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন এবং তাঁর সম্মানে য়াছরিবের নামকরণ করা হয় মদীনাতুন্নবী ইতিহাসে যা মদীনা মুনাওয়ারা- সত্যের আলোকে সমুজ্জ্বল নগরী নামে খ্যাত। শান্তিপূর্ণ উপায়ে আল্লাহর দীনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই তিনি মক্কা ও অন্যান্য স্থান হতে মুহাজিররূপে মদীনায় আগত মুসলিম এবং স্থানীয় মুসলিম আনসারগণকে ভ্রাতৃত্বের অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করেন । মদীনা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ইহুদী-নাসারা প্রভৃতি অমুসলিম সম্প্রদায়ের পূর্ণ ধর্মীয় ও মানবিক অধিকার রক্ষা এবং দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার মহৎ উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার একটি ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তিও সম্পাদন করেন। মদীনার এই চুক্তিই মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম মানবাধিকারের লিখিত সনদ, বিশ্বমানবের সাম্য, মৈত্রী ও শাস্তির ঘোষণা, ইসলামের এই প্রাথমিক সাফল্য যে অচিরেই মহা বিজয়ে পরিণত হবে একথা উপলব্ধি করে মক্কার পৌত্তলিক কুরায়শ ও মদীনার ইহুদী সম্প্রদায় হিংসায় ও ক্ষোভে জ্বলে উঠে।

মক্কাবাসী প্রকাশ্যে এবং মদীনার ইহুদী গোত্রগুলো গোপনে ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্ব ধরাপৃষ্ঠ হতে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। আরবের বিভিন্ন গোত্রগুলোকেও তাদের সাথে জোটবদ্ধ করতে তারা সমর্থ হয়। পার্শ্ববর্তী দুটি বৃহৎ শক্তি পারস্য ও বাইজান্টাইনের সাথেও তারা ইসলামের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্র করে। শত্রুপক্ষের এসব গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এবং তাদের সমরাস্ত্র সুসজ্জিত সুদক্ষ সম্মিলিত বিরাট বাহিনীর অর্ধশতাধিক প্রচণ্ড আক্রমণ প্রতিহত করে। ইসলামের বিজয় পতাকা যেভাবে তিনি সমুন্নত রাখতে সম্মত হন, তাতে একটি ক্ষুদ্র বাহিনীর সেনানায়করূপে মহানবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিস্ময়কর রণনৈপুণ্য, অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, দুর্জয় সাহস এবং বীরত্বের পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। সর্বোপরি যুদ্ধে ধ্বংসলীলা ও রক্তপাত বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর উদ্যোগ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা যুদ্ধবন্দীদের সাথে দয়ার্দ্র ব্যবহার, যুদ্ধাবস্থা নিরসনের উদ্দেশ্যে নিজকে বিপন্ন করে। শত্রুদের প্রতি করুণা প্রদর্শন, যুদ্ধাপরাধীগণের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, শত্রুতার অবসানকল্পে বাহ্যত অসম্মানজনক শর্তে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন এসব ঘটনা অকাট্যরূপে প্রমাণ করে যে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেনানায়করূপেও ছিলেন বিশ্বমানবের সর্বকালের মহান আদর্শ, শান্তির সেনানায়ক, রাহমাতুল্লিল আলামীন।

ইব্‌ন সাকর-এর বর্ণনা মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় মদীনায় দশ বৎসরে তাঁকে শত্রুপক্ষের ১০ (দশ) টি ছোট বড় ও খণ্ড আক্রমণের মুকাবিলা করতে হয়, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে, কিংবা তাদের আক্রমণের আশংকা হতে নিষ্কৃতি লাভ অথবা তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি অগ্রভাগেই বিপর্যস্ত করার উদ্দেশ্যেই মুসলিমগণ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নির্দেশ ও নেতৃত্বে যুদ্ধে গমন করেছেন। মদীনার মুসলিম মুজাহিদগণ কোন সময়ই আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি, শত্রুপক্ষ কিংবা শত্রুদেশ কখনও তিনি প্রথমে আক্রমণ করেননি। মুসলিম স্বেচ্ছাবাহিনীকে সংগঠিত করা, সর্বাবস্থায় সুনিয়ন্ত্রণে রাখা, অযথা রক্তপাত, লুণ্ঠন এবং নৈতিকতাবিরোধী আচার-আচরণ হতে প্রত্যেক মুজাহিদকে নিবৃত্ত রেখে একমাত্র আল্লাহর দীনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে অকুতোভয়ে জান, মাল সর্বস্ব আল্লাহর পথে বিলিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করতে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন ইতিহাসে তা চিরস্মরণীয় হতে থাকবে।

শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য জিহাদের ময়দানে রওয়ানার সময় মুজাহিদীনের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ ছিল, তোমরা কখনো বৃদ্ধ, শিশু, নারী ও ধর্মযাজককে হত্যা করবে না, ফলবান বৃক্ষ ও শস্যক্ষেত্র পোড়াবে না। বস্তুত এসব আত্মরক্ষামূলক কোন যুদ্ধেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো জ্বালাও-পোড়াও নীতি অবলম্বন করেননি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজীবন অন্যায়ের মুকাবিলা ন্যায় দ্বারা, অসত্যের মুকাবিলা সত্যের দ্বারা করেছেন। যুদ্ধের ময়দানেও তাই তিনি শান্তির দূতরূপেই হাযির হতেন। এ সম্পর্কে আল্লাহর নির্দেশ তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।

আল্লাহর নির্দেশ ছিল – ادفع بالتي هي أحسن السيئة –

“মন্দের মুকাবিলা কর মহোত্তম পন্থায়।” (সূরা মু’মিনুন ৪৯৬)

ومن أحسن قولا ممن دعا إلى الله وعمل صالحا وقال انني من المسلمين ولا تستـوى الحسنة ولا السيئة ادفع بالتي ، هی احسن فاذا الذي بينك وبينه عداوة كانه ولى حميم

“এবং ঐ ব্যক্তির চেয়ে কথায় কে উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে, নিজেও সৎকর্ম করে এবং বলে আমি তো আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারীদের (মুসলিমদের) অন্তর্ভুক্ত, সৎকাজ এবং মন্দকাজ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর মহোত্তম পন্থায়, তাহলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে তোমার বন্ধুর মত হয়ে যাবে।” (সূরা হা-মীম আস্-সিজদা : ৩৩-৩৪)

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সাথে যুদ্ধজয়ের পর যুদ্ধবন্দীদের সাথে যে সদ্ব্যবহার করেছিলেন এবং রক্তপাত বন্ধের জন্য যেসব সন্ধি করেছিলেন তাতে তিনি বিস্ময়করভাবে শত্রুমন জয় করতে সক্ষম হন। মহানবীর একটা রণকৌশল ছিল শ মনে ভীতি সঞ্চার। ফলে কয়েকবারই যুদ্ধক্ষেত্র হতে শত্রুপক্ষ পলায়ন করে, কিংবা যুদ্ধের আয়োজন করেও পরাজয়ের আশঙ্কায় আক্রমণ হতে নিবৃত্ত থাকে। যুদ্ধ জয় যে শুধু সৈন্যসংখ্যা বা অস্ত্রশস্ত্রের উপর নির্ভর করে না, এই সত্যটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক মু’মিন মুজাহিদকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করাতে সক্ষম হন। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, মুসলমান সত্যের জন্য জিহাদ করছে, তাঁরা প্রত্যেকেই আল্লাহর সৈনিক জুনদুল্লাহ এবং তাদের বাহিনী আল্লাহর বাহিনী হিজবুল্লাহ, তারা জয়ী হলে গামী হবে, শহীদ হলে জান্নাতে অমর জীবন লাভ করবে। অপরদিকে শত্রুপক্ষ হিংসা-বিদ্বেষ ও আক্রোশের বশবর্তী হয়ে অন্যায়, মিথ্যা অসত্যের জন্য লড়ছে। কাজেই তাদের পরাজয় অনিবার্য, মুসলমানদের এই আন্তরিক বিশ্বাস তাদেরকে অজেয় মনোবলের অধিকারী করে। সংখ্যায় ও অস্ত্রশস্ত্রে শত্রুর তুলনায় নগণ্য হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বে মুসলিম স্বেচ্ছাবাহিনী কখনো পরাজয়ের মনোভাব নিয়ে জিহাদে শরীক হননি। প্রত্যেক মুসলমানকে অস্তত দশজন কাফেরের আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে- এইরূপ কঠোর সংকল্প নিয়েই প্রত্যেক মুসলিম জিহাদে শরীক হতেন এবং শাহাদাতের অমৃত পেয়ালা পানের জন্য তাঁরা সর্বদা আকাঙ্ক্ষিত থাকতেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নেতৃত্বের মহত্ত্ব ও মুজাহিদদের বীরত্ব ও অসম সাহসিকতা প্রসঙ্গে আল কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে—

يا ايها النبي حسبك الله ومن اتبعك من المؤمنين يا ايها النبي حرض المؤمنين على القتال ان يكن منكم عشرون صابرون يغلبوا مأتين وان يكن منكم مائة يغلبوا الفا من الذين كفروا بانهم قوم لا يفقهون

“হে নবী! আপনার জন্য ও আপনার অনুসারী মুমিনদিগের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, হে নবী। মুমিনদেরকে সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করুন, আপনাদের মধ্যে বিশজন ধৈর্যশীল থাকলে তারা দুইশ জনের উপর বিজয়ী হবে এবং আপনাদের মধ্যে একশ জন থাকলে এক সহস্র কাফেরের উপর বিজয়ী হবে। কেননা তারা এমন লোক যারা (সত্য ধর্মের) জ্ঞান রাখে না।” (সূরা আনফাল : ৬৪-৬৫)

শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজন হলে তাদের মুকাবিলা করার উদ্দেশ্যে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার বিভিন্ন দিকে বিশিষ্ট কোন সাহাবীর নেতৃত্বে ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করতেন। এ ধরনের ক্ষুদ্র তল্লাসী ও অনুসন্ধানী অভিযানকে সারিয়্যা বলা হয়। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এই সারিয়্যার মোট সংখ্যা ৪৩টি। এই ধরনের অনুসন্ধানী তৎপরতার ফলে শত্রুপক্ষ কখনো অতর্কিত আক্রমণে মুসলমানদের বিপদে ফেলতে সক্ষম হয়নি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে শত্রুর অতর্কিত আক্রমণে মদীনার মুসলিমগণকে বহুবার বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতো। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং যেসব জিহাদে শরীক হয়েছেন তাকে গাযওয়া বলা হয়। এই গাওয়ার সংখ্যা বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী ১৬টি হতে ২৩টি। ইমাম বুখারী ১৯টি গাওয়ার উল্লেখ করেছেন। এগুলোর মধ্যে ৭টি গাযওয়াই প্রসিদ্ধ। উহুদ ও হুনায়নের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ পূর্ণভাবে পালিত না হওয়ার কারণে মুসলিম বাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল, কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিস্ময়কর বিচক্ষণতা, সাহস ও কর্মতৎপরতার ফলে এই অপ্রত্যাশিত পরাজয় পরিণত হয়েছিল মহান বিজয়ে। এভাবে হযরতের মহান নেতৃত্বে প্রত্যেকটি জিহাদেই মুসলমান বিজয় গৌরব অর্জন করে।

শত্রুপক্ষের যেকোন আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথাসম্ভব সাধ্যানুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন এবং সদা সতর্কাবস্থায় থাকতেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ তিনি পূর্ণভাবে অনুসরণ করেছেন :

وأعدوا لهم ما استطعتم من قوة ومن رباط الخيل ترهبون به عدو الله وعدوكم وأخرين من دونهم لاتعلمونهم الله يعلمهم

“তোমরা শত্রুর মুকাবিলার জন্য তোমাদের সাধ্যানুযায়ী অস্ত্রশস্ত্র এবং অশ্ব বাহিনী প্রস্তুত রাখবে যদ্দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এ ছাড়া অন্যান্য লোকজনকে, যাদের তোমরা জান না, আল্লাহ্ জানেন।” (সূরা আনফাল : ৬০)

সর্বোপরি সাধ্যানুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণের পর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা আল্লাহর সাহায্য প্রার্থী হতেন এবং তার উপর তাওয়াক্কুল করতেন, যুদ্ধের ময়দানে তিনি আল্লাহর কাছে দোআ করতেন ঃ হে রাব্বুল আলামীন, আজ যদি এই ক্ষুদ্র বাহিনী ধ্বংস হয়ে যায় তবে এই দুনিয়াতে তোমাকে ডাকবার এবং তোমার বন্দেগী করার মত কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।”

ইসলাম, মুসলমান এবং মদীনার সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষার এইসব জীবন-মরণ সংগ্রামে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো বিদেশী কোন বৃহৎ শক্তির সাথে গোপন আঁতাত কিংবা তাদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতার আবেদন করেননি। তিনি সাহাবায়ে কিরামের ক্ষুদ্র দল নিয়েই দশটি বৎসর শত্রুর মুকাবিলা করেছেন। ইসলামের দাওয়াত যেভাবে তিনি কুরায়শসহ আরবের বিভিন্ন গোত্রের কাছে দিয়েছেন তেমনিভাবে পারস্যের কিসরা, বাইজান্টাইনের কায়সার, মিসরের মাকুকাস এবং আবিসিনিয়ার নাজ্জাসীর কাছেও দূতের মাধ্যমে তা পৌঁছিয়েছেন। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে আল্লাহর রাসূল যুদ্ধের পোশাকে কি উদ্দেশ্যে জিহাদের ময়দানে নেতৃত্ব দিতেন। মানব ইতিহাসের এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সর্বস্ব বিপন্ন করে যদি অসীম সাহসিকতা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে আরবের পৌত্তলিক, ইহুদী ও নাসারাদের সশস্ত্র আক্রমণ প্রতিহত না করতেন তাহলে এই দুনিয়া হতে ধর্মীয়, মানবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ চিরতরে লুপ্ত হয়ে যেত এবং মানব সভ্যতার অগ্রগতির পথও চিরকালের জন্য রুদ্ধ হয়ে যেত।

আল কুরআনের কয়েকটি আয়াত এই ঐতিহাসিক সত্যেরই সাক্ষ্য বহন করে :

أذن للذين يقتلون بأنهم ظلموا وان الله على نصرهم لقدير ـ الذين أخرجوا من ديارهم بغير حق الأ أن يقولوا ربنا الله ولولا دفع الله الناس بعضهم ببعض لهدمت صوامع وبيع وصلوت و مـسـجـد يذكر فيها اسم الله كثيرا ولينصرن الله من ينصره ان الله لقوى عزيز

“যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদের সাহায্য করতে পূর্ণ শক্তিমান। যারা নিজেদের ঘরবাড়ী হতে অন্যায়ভাবে বিতাড়িত হয়েছে শুধু এই কারণে যে তারা বলে ও আমাদের রব একমাত্র আল্লাহ্’। আর আল্লাহ্ যদি মানব জাতির একদলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন তাহলে ধ্বংস হয়ে যেত খ্রিস্টানদের মঠ, গির্জা, ইহুদীদের উপাসনালয় আর সেই মসজিদসমূহ যাতে অধিক পরিমাণে স্মরণ করা হয় আল্লাহর নাম। আল্লাহ নিশ্চয় তাকে সাহায্য করেন যে তাঁকে সাহায্য করে। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই শক্তিমান, পরাক্রমশালী।” (সূরা হজ্জ ৩৯-৪০)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন প্রকাশ্য শত্রুর মুকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন, তেমনিভাবে মদীনার মুনাফিক, ইহুদী নও-মুসলিমদের গোপন ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও সর্বদা সচেতন ছিলেন, এই প্রভাবশালী মুনাফিক মুসলিম দল আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে এবং বিভিন্ন গোত্রভুক্ত মুসলিমদের মধ্যে অন্তর্ঘাত ও দ্বন্দ্ব-ক সৃষ্টির অপপ্রয়াসে সর্বদা লিপ্ত ছিল । রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিভীষণ-বাহিনীর সাথে সর্বদা সদয় ব্যবহার করলেও তারা যাতে অন্তর্বিপ্লব সৃষ্টির সুযোগ না পায় সে সম্পর্কে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে এই গৃহশত্রুর দল মুজাহিদীনের মধ্যে আত্মঘাতী বিরোধ সৃষ্টির যে কূট-কৌশলের জাল বিস্তার করত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাথে সেসব ছিন্ন করার তাৎক্ষণিক কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ইসলামের ইতিহাস হয়ত অন্যভাবে লিখিত হতো। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, গৃহশত্রুদের সম্পর্কে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদর্শিতার সাথে যেসব সাবধানতা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বাগদাদের শেষ আব্বাসীয় খলীফা মুস্তাসিম বিল্লাহ, দিল্লীর শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ এবং বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা অনুরূপ কর্মপন্থা ও পদ্ধতি অবলম্বন করলে বিশ্ব মুসলিমের কখনো কলঙ্কজনক ভাগ্য বিপর্যয় ঘটতো না।

বিশ্বের বিভিন্ন জাতীয় দিগ্বিজয়ী সেনানায়ক এবং যীশুখ্রীস্টের নামে ইসলাম ও মুসলিম জাতির বিরুদ্ধে পরিচালিত ক্রুসেড বাহিনীর যাজক সেনাপতিগণের কর্মতৎপরতার সাথে সেনানায়করূপে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্মতৎপরতার তুলনামূলক পর্যালোচনা করলে একদিকে ভেসে উঠে ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যালীলা, নিপীড়ন, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের ভয়াবহ বীভৎস দৃশ্য, অন্যদিকে মূর্ত হয়ে উঠে মানবতা, দয়া, করুণা ও শান্তির চির আকাঙ্ক্ষিত উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও মক্কা বিজয়ের ঐতিহাসিক ঘটনা হতেও প্রমাণিত হয় যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিহাদের ময়দানেও ছিলেন শান্তির সেনানায়ক মানবতার পতাকাবাহী মুক্তির দূত। সাহাবায়ে কিরামের আপত্তি সত্ত্বেও রক্তপাত বন্ধ এবং বৈরিতার অবসানের আশায় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার কুরায়শদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধি স্থাপন করেন। সন্ধির শর্তাবলী ছিল কুরায়শদের স্বার্থের অনুকূলে এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতিকূলে। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছিলেন যে, আপাত দৃষ্টিতে হুদায়বিয়ার শান্তিচুক্তি মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থী মনে হলেও অচিরেই এই চুক্তি সূচনা করবে ইসলামের প্রসার এবং শান্তি ও মৈত্রীর এক নতুন অধ্যায়। আল কুরআনে হুদায়বিয়ার এই শান্তিচুক্তিকে ইসলামের মহাবিজয় বলে ঘোষিত হয়েছে।

হুদায়বিয়ার সন্ধির ন্যায় মক্কা বিজয়ের ঘটনা হতেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গভীর প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, ঔদার্য, মহত্ত্ব, ক্ষমাপরায়ণতা, করুণা ও মানবপ্রেমের উজ্জ্বল ছবি উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। দীর্ঘ বিশ বৎসর ধরে যাদের নির্মম অত্যাচার-নিপীড়নে প্রিয় নবী ও সাহাবায়ে কিরাম অসহনীয় দুঃখ-যাতনা ভোগ করেছেন, প্রিয় জন্মভূমি হতে হিজরত করেছেন, যারা তাঁদের জীবন নাশের প্রচেষ্টায় কোন ত্রুটি করেনি এবং ইসলামের আলো চিরতরে নির্বাপনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, ইসলামের সেই চিরশত্রু দলকে লক্ষ্য করে মক্কা বিজয়ের চিরস্মরণীয় মুহূর্তে মানবতার মহানবী, শান্তির সেনানায়ক ঘোষণা করলেন : “হে মক্কাবাসীগণ! তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অভিযোগ নাই, যাও আজ তোমরা সকলেই মুক্ত, সকলেই স্বাধীন।” পরাজিত শত্রুর সাথে এরকম উদাহরণ মহানুভব আচরণের নজির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাতার বাহিনী বাগদাদ অধিকার করে, কুরায়শরা জেরুযালেম অধিকার করে, খ্রীষ্টান বাহিনী কর্ডোভা ও গ্রানাডা অধিকার করে এবং ১৯৪৮ সনে ইহুদীরা পবিত্র জেরুযালেম অধিকার করে যে পশুসুলভ ধ্বংসলীলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল এবং অবশিষ্ট মুসলিম অধিবাসীগণকে নৃশংসভাবে স্বদেশ হতে বিতাড়িত করেছিল তাতে পাষণ্ডের হৃদয়ও শিহরিত হয়। বস্তৃত রাসুলে আকরামের সারা জীবনের ঘটনা পর্যালোচনা করলে যেকোন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করবে তিনি ছিলেন বিশ্বমানবের দরদী বন্ধু রাহমাতুল্লিল আলামীন।

মুসলিম দেশসমূহ যদি আন্তরিকভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এসব জীবনাদর্শ অনুসরণ করত তাহলে মুসলিম জাতির আজ এত অধঃপতন ও দুর্গতি হতো না। মুসলিম জাহানের বর্তমান ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বিশ্বের মুসলিম জনগণ রাব্বুল আলামীনের কাছে কাতরভাবে এই মুনাজাত করছে।

মক্কা বিজয়ের সাথে পূর্ণ হলো ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আল্লাহর এই প্রতিশ্রুতি-

وعد الله الذين أمنوا منكم وعملوا الصلحت ليستخلفنهم في الأرض كـمـا اسـتخلف الذين من قبلهم وليمكنن لهم دينهم الذي ارتضى لهم وليبد لنهم من بعد خوفهم أمنا يعبدونني لا يشركون بي شيا ومن كفر من بعد ذلك فأولئك هم الفسقون ـ وأقيموا الصلوة وأتوا الزكوة وأطيعوا الرسول لعلكم ترحمون

“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে ও সৎকর্ম করবে আল্লাহ্ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে খিলাফত দান করবেন যেমন তিনি খিলাফত দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তীগণকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য সুদৃঢ় করবেন তাদের দীনকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমারই ইবাদত করবে, আমার সাথে কোন শরীক করবে না। এরপরও যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তবে তারা হবে নাফরমান। তোমরা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে এবং রাসূলের আনুগত্য করবে, যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।” (সূরা নূর ৪৫৫-৫৬)

মহানবীর মহান নেতৃত্ব যে মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর বিশেষ দান ও অনুগ্রহ এবং খিলাফতের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে ব্যক্তিগত খেয়াল খুশীর অনুসরণ না করে মহানবীর জীবনাদর্শের অনুসরণ করা একান্ত কর্তব্য সে সম্বন্ধে আল কুরআনের ঘোষণা –

واعلموا أن فيكم رسول الله لويطيعكم في كثير من الأمر لعنتم ولكن الله حيب اليكم الايمان وزينه في قلوبكم وكره اليكم الكفر والفسوق والعصيان أولئك هم الرشدون ـ فضلا من الله ونعمة والله عليم حكيم

“তোমরা জেনে রাখ যে, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন। এমন অনেক বিষয় আছে যে, যদি তিনি তাতে তোমাদের মতানুসরণ করেন তবে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আল্লাহ তোমাদের নিকট ঈমানকে প্রিয় করেছেন এবং তোমাদের অন্তরসমূহে তা পরিশোভিত করে দিয়েছেন। কুফরী পাপাচার ও অবাধ্যতাকে তোমাদের নিকট অপ্রিয় করেছেন। সব লোকই তো সৎপথ অবলম্বনকারী। আর এ হলো আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।” (সূরা হুজরাত : ৭-৮)

উল্লিখিত আয়াতসমূহ হতে নিঃসন্দেহভাবে প্রমাণিত হচ্ছে যে কোন পার্থিব স্বার্থ বা জাগতিক উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈনিকরূপে জিহাদের ময়দানে হাযির হননি কিংবা জিহাদের নেতৃত্ব দেননি কুরায়শগণ তো হিজরতের পূর্বেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে তাওহীদী মতবাদ পরিত্যাগ করলে তাঁকে আরবের বাদশাহী, স্বর্ণের সিংহাসন, অগাধ ধনরত্ন এবং পরমাসুন্দরী রমণীর প্রস্তাব দিয়েছিল, যা তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা প্রমাণ করে যে তাগুতী শক্তির অত্যাচার, উৎপীড়ন ও শোষণ হতে বিশ্বমানবের মুক্তি, আল্লাহর যমীনে আল্লাহর শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও মানবিক মূল্যবোধের আদর্শে একটি উন্নত, মহৎ জাতি উম্মতে মুসলিম-এর সংগঠনই ছিল তাঁর সারা জীবনের সাধনা, জিহাদ, ত্যাগ ও তিতিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য। ভোগ-বিলাস, সম্পদ, রাজত্ব যে তার উদ্দেশ্য ছিল না মক্কা বিজয়ই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তৎকালীন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তিনি ইচ্ছা করলে পরাজিত শত্রুর ঘর-বাড়ী ধ্বংস, অর্থ-সম্পদ এবং মক্কার নর-নারীকে চিরকালের জন্য দাসদাসীতে পরিণত করতে পারতেন, তিনি যা ধ্বংস করেছিলেন তা হলো কাবা গৃহের ৩৬০টি প্রতিমা আর মক্কার রাস্তাঘাট শত্রুর রক্তের পরিবর্তে রঞ্জিত হয়েছিল পরিত্যক্ত শরাবের সয়লাবে। চতুর্দিকে শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে আক্রমণের মুখেও যুদ্ধের ময়দানে যিনি সালাত কায়েম করতেন তাঁর সম্পর্কে একথা চিন্তা করাও মহাপাপ হবে যে তিনি ব্যক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থ বা স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ ও জীবন বিপন্ন করে এতগুলো জিহাদ পরিচালনা করেন। বস্তুত প্রত্যেকটি জিহাদই প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন মানবতার আদর্শের দিশারী, আদর্শ মানব বন্ধু, আদর্শ সিপাহসালার, আদর্শ মানুষ, ইনসানে কামিল।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহান নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে মদীনায় ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত এবং উম্মাতে মুসলিমা সংগঠিত হলে, নবুওয়াত ও খিলাফতের যে গুরুদায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত হয়েছিল তা সাফল্যমণ্ডিত হলো, আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হলো এবং পূর্ণতা লাভ করলো বিশ্বমানবের চিরন্তন ধর্ম দীনে ইসলাম। মহানবীর জীবন সাধনার এই চরম ও পরম সাফল্যে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রিযামন্দী ঘোষিত হয়েছে আল-কুরআনের এই আয়াতে :

اليـوم يئس الذين كفروا من دينكم فلا تخشوهم واخشون الـيـوم أكملت لكم دينك واتممت عليكم نعمتي ورضيت لكم الاسلام دينا

 “আজ কাফেররা তোমাদের দীনের প্রতিরোধে নিরাশ হয়েছে, সুতরাং তাদেরকে ভয় করো না, আমাকেই শুধু ভয় করবে। আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং আমি মনোনীত করলাম ইসলামকে তোমাদের একমাত্র দীন।” (সূরা মায়িদা : ৩)

হযরত আদম (আ) হতে হযরত ঈসা (আ) পর্যন্ত কোন নবীই ইসলামের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের সৌভাগ্য লাভ করেননি। খিলাফত প্রতিষ্ঠার দায়িত্বও তাঁদের উপর ছিল না, তাঁদের জীবদ্দশায় তাঁদের অনুগতদের সংখ্যাও ছিল অতি নগণ্য। সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে তাগুতী শক্তির মুকাবিলা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ তাদের উপর ফরয ছিল না। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর উম্মতের উপর অন্যায় ও অসত্যের প্রতিরোধের লক্ষ্যে জিহাদ তাদের উপর ফরয করা হয়েছে।

এ সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ–  فلا تطع الكفرين وجاهدهم به جهادا كبيرا

“অতএব আপনি কাফেরদের আনুগত্য করবেন না এবং কুরআনের সাহায্যে তাদের সাথে প্রবল সংগ্রাম চালিয়ে যান।” (সূরা ফুরকান : ৫২)

وقتلوهم حتى لاتكون فتنة ويكون الدين الله فان انتهو فلاعدوان الأعلى الظلمين .

“ফিতনা-ফাসাদের অবসান এবং আল্লাহর দীন সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে। অতঃপর যদি তারা যুদ্ধে বিরত থাকে তবে যালিমগণ ব্যতীত আর কাউকে আক্রমণ করবে না।” (সূরা বাকারা : ১৯৩)

মহানবীর নেতৃত্বে ও শিক্ষাধীনে যে জুনদুল্লাহ বা আল্লাহর সৈনিকগণ তৈরী হয়েছিলেন তাদের আত্মত্যাগ, সত্যনিষ্ঠা, মহানুভবতা, বীরত্ব ও সাহসিকতার কাহিনী ইসলামের ইতিহাসের একটি গৌরবময় অধ্যায়। আল্লাহর কাছে নিবেদিত প্রাণ মুজাহিদ সাহাবীদের জিহাদী চেতনা সম্পর্কে আল-কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে ঃ

يقاتلون في سبيل الله فيقتلون ويقتلون

“তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, (আক্রমণকারীকে হত্যা করে ও নিহত হয়।” (সূরা তাওবা : ১১১)

দীর্ঘ ২৩ বৎসরের কঠোর সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে মুসলিম উম্মাহর একটি সুসংগঠিত আত্মনিবেদিত সত্যনিষ্ঠ ও শান্তিপ্রিয় আদর্শ জাতি এবং একটি কল্যাণধর্মী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ণ হলো মহানবীর প্রতি ন্যস্ত মহান দায়িত্ব। মহান প্রভু, রফীকে আ’লার সাথে মিলিত হবার পূর্বে তিনি তাঁর উম্মত এবং বিশ্বমানবের হিদায়াত ও দিকনির্দেশনার জন্য রেখে যান আল্লাহর কালাম ও স্বীয় অমর বাণী। তিনি দৈহিকভাবে এ নশ্বর দুনিয়া হতে বিদায় নিলেও তাঁর আদর্শ ও শিক্ষার মাধ্যমে সিরাজুম মুনীরার ন্যায় তিনি আমাদের মধ্যে চিরভাস্বর, চির অমর হয়ে আছেন ও থাকবেন।

واعلموا أن فيكم رسول الله

“আর তোমরা জেনে রাখবে, তোমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রয়েছেন।” (সূরা হুজরাত : ৭)

আল্লাহ পাকের এই ঘোষণা শুধু সমকালীন সাহাবীদের জন্য নয় বরং সর্বকালের উম্মতে মুহাম্মদীয়ার জন্য। তাঁর আদর্শ, নীতি ও কর্মপদ্ধতির বিরুদ্ধাচরণ করে মুসলিম বিশ্ব কখনো অভীষ্ট লক্ষ্য মনুযিলে মাকসুদে পৌঁছতে পারবে না।

“প্রকৃত সফলতার চাবিকাঠি নিহিত রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণে।”

ومن يطع الله ورسوله فقد فاز فوزا عظيما ۔

“যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করবে তারা অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে।” (সূরা আহযাব : ৭১)

ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতির দৈনন্দিন জীবনের সর্বক্ষেত্রে ও সর্বব্যাপারে, ঈমান-আমলে ও ধ্যান-ধারণা, শাসন, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থায়, অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা, প্রতিরক্ষা ও আন্তর্জাতিক ব্যাপারে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান আদর্শের অনুসরণ করেই মুসলিম উম্মাহ তাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধানে সক্ষম হবে এবং আবার বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি হিসাবে মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে।


আরো জানতে ক্লিক করুন

কুরআনুল কারীমের আলোকে প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন-দর্শন



কোন মন্তব্য নেই

Please do not enter any spam link in the comment box.

Blogger দ্বারা পরিচালিত.